পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছে জুম চাষ কেবল একটি কৃষিপদ্ধতি নয়, বরং তাদের জীবন ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে শত শত বছর ধরে এই ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজ পরিচালিত হয়ে আসছে।
জুম চাষের একটি বিশেষত্ব হলো একই জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন। পাহাড়ের ঢালে ঝোপঝাড় ও আগাছা পরিষ্কার করে শুকিয়ে তাতে আগুন ধরানো হয়। এরপর বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে একই সাথে ধান, ভুট্টা, মারফা, কুমড়া, তিল, হলুদ, আদা ও মরিচসহ বিভিন্ন শস্যের বীজ বপন করা হয়। এই মিশ্র ফসল উৎপাদন পদ্ধতি জুম চাষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই জুম চাষের মাধ্যমে পাহাড়ি পরিবারগুলো তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তবে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ও বিকল্প জীবিকার অভাব জুম চাষকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এই অঞ্চলে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, সবজি চাষ এবং ফলদ বাগান স্থাপনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়া এই পরিবারগুলোর জন্য জুমের বিকল্প গ্রহণ করা কঠিন।
রোয়াংছড়ি উপজেলার আংজাই পাড়া এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মূল সড়ক থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে একটি বিশাল টিলার ওপর দৃষ্টিনন্দন জুম খেত। এই খেতে ধান, ভুট্টা, মারফা, মরিচ, হলুদ, আদা এবং কুমড়াসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ফলানো হয়েছে। খেতের মাঝখানে ছন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি দুটি ঝুপড়ি ঘর জুম চাষিদের বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করা হয়। টিলার চূড়া থেকে আশেপাশের পাইক্ষ্যং ও রোয়াংছড়ি মৌজার ছোট ছোট গ্রাম এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ে।
জুম চাষ কেবল ফসল উৎপাদনের একটি প্রক্রিয়া নয়, এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক বন্ধনকেও সুদৃঢ় করে। জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ফসল কাটা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পাহাড়ি পরিবারগুলো দলবদ্ধভাবে কাজ করে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে জুম চাষের পরিবেশগত প্রভাব ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।