গত বছর বাংলাদেশে একের পর এক ভয়াবহ মব জাস্টিস হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে গভীর শোক ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীদের উপর চড়াও হয়েছে, শিক্ষার্থীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, আর গুজবের প্রভাবে সাধারণ মানুষ সন্দেহভাজনদের প্রকাশ্যে শাস্তি দিয়েছে—যেখানে কোনো আদালত, কোনো বিচারপ্রক্রিয়া নেই।
৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর সংঘটিত এসব ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং আইনের শাসনের ক্রমাগত অবনতির ইঙ্গিত।
ভুক্তভোগীদের পরিবার অসীম শোক ও বঞ্চনার মুখোমুখি হয়েছে, এবং রাষ্ট্রীয় সংবিধানে জীবন ও স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেওয়া আছে, তা ভয়াবহভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
যাচাইকৃত মব জাস্টিসের ঘটনাসমূহ:
২৭ আগস্ট ২০২৪ – তানোর, রাজশাহী
ইলামদহী বাজারের ১৮ বছর বয়সী সোহান আলীকে চুরির সন্দেহে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে।
স্থানীয় দোকানপাট লুটের ঘটনার পর তাকে চোর ভেবে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সোহানের মৃত্যু হয়।
পুলিশ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলেও, এই হত্যাকাণ্ড ঘটে সম্পূর্ণভাবে বিচারবহির্ভূত জনতার হাতে।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ফজলুল হক হল)
মানসিকভাবে অসুস্থ ৩৫ বছর বয়সী তোফাজ্জলকে ছাত্ররা ভুলবশত চোর সন্দেহে ধরে মারধর করে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রহারের পর তিনি হাসপাতালে মারা যান। পরে জানা যায়, তিনি কোনো অপরাধই করেননি।
এই ঘটনা প্রমাণ করে, অজ্ঞতা ও ভয়ের মিলনে জনতার বিচার কতটা নির্মম হতে পারে।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ – খাগড়াছড়ি শহর
৪০ বছর বয়সী মামুনকে বাইক চুরির অভিযোগে জনতা হত্যা করে।
তার মৃত্যুর পর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে—যার ফলে পরবর্তী কয়েক দিনে আরও কয়েকজন প্রাণ হারান।
একটি একক মব জাস্টিস ঘটনা কীভাবে সম্পূর্ণ জাতিগত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটাতে পারে, এটি তার ভয়াবহ উদাহরণ।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ – জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৩২ বছর বয়সী প্রাক্তন ছাত্রনেতা শামীম আহমেদকে সহপাঠীরা নির্যাতন করে হত্যা করে।
তাকে “বিক্ষোভে হামলার দায়ে অভিযুক্ত” করে ক্যাম্পাসেই প্রহার করা হয়।
পরে ক্যাম্পাসে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, এবং ছাত্রসমাজ “ন্যায়বিচার চাই” শ্লোগানে উত্তাল হয়—এক নির্মম বিদ্রূপ, যেখানে বিচারের দাবি করা হয় আরেক অবিচারের পর।
১৬ অক্টোবর ২০২৪ – টঙ্গী, গাজীপুর
চুরির সন্দেহে ১৮ বছর বয়সী অটোরিকশা চালক সাব্বির হোসেনকে নির্মমভাবে পেটানো হয়।
রাত ১১টার দিকে জনতা তাকে ধরে প্রহার করে; হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ১টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ পরদিন কয়েকজনকে আটক করে, কিন্তু বিচারের অগ্রগতি আজও অনিশ্চিত।
৩ জুলাই ২০২৫ – করোইবাড়ি, মুরাদনগর (কুমিল্লা)
প্রায় ১৫০ জন গ্রামবাসী গুজবের ভিত্তিতে এক মা ও দুই সন্তানকে হত্যা করে।
“মাদক ব্যবসার অভিযোগে” লাঠি, ইট ও ছুরি নিয়ে তারা বাড়িতে হামলা চালায়।
৫৩ বছর বয়সী রোখসানা আক্তার, ছেলে রাসেল ও মেয়ে জোনাকি ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
পুলিশ আটজনকে গ্রেপ্তার করলেও এই হত্যাকাণ্ড হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস মব জাস্টিসের উদাহরণ।৯
জুলাই ২০২৫ – পুরান ঢাকা (মিটফোর্ড এলাকা)
ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে চাঁদাবাজ গোষ্ঠীর হাতে লালচাঁদ “সোহাগ” প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হত্যার পর হামলাকারীরা লাশের উপর নাচছে।
এই ঘটনা দেখায়—আইন যখন নিশ্চুপ থাকে, তখন জনতা ন্যায়ের ছদ্মবেশে বর্বরতায় নেমে আসে।
সাংবিধানিক প্রভাব:
প্রতিটি মব জাস্টিস ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে—
অনুচ্ছেদ ৩২: “আইন অনুসারে ব্যতীত কোনও ব্যক্তিকে জীবন বা স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।”
→ প্রতিটি ঘটনা জীবনবঞ্চনার স্পষ্ট উদাহরণ।
অনুচ্ছেদ ৩১: “প্রত্যেক নাগরিক আইনের সুরক্ষা পাবেন।”
→ কোনো ভুক্তভোগী সেই সুরক্ষা পাননি।
অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের সামনে সকলের সমতা।
→ জনতার হাতে সন্দেহভাজনদের “দোষী সাব্যস্ত” করা এই নীতিকে ধ্বংস করেছে।
অনুচ্ছেদ ৩৫: নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ নিষিদ্ধ।
→ ইট, লাঠি, লাথি—সবই সেই নিষেধাজ্ঞার নির্মম লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশ ICCPR (International Covenant on Civil and Political Rights)
ও UNCAT (Convention Against Torture)-এর সদস্য রাষ্ট্র।
এই আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী—
1. ICCPR অনুচ্ছেদ ৬: জীবন থেকে নির্বিচারে বঞ্চিত করা নিষিদ্ধ।
→ মব জাস্টিসে নিহতদের কোনো আদালতীয় রায় ছিল না।
2. ICCPR অনুচ্ছেদ ৭ / CAT অনুচ্ছেদ ১৬: নির্যাতন ও নিষ্ঠুর আচরণ নিষিদ্ধ।
→ জনতার প্রহার এসব ধারা স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে।
3. ICCPR অনুচ্ছেদ ১৪: ন্যায্য বিচারের অধিকার।
→ কোনো ভুক্তভোগী সেই অধিকার পায়নি।
4. ICCPR অনুচ্ছেদ ২: রাষ্ট্রের দায়িত্ব কার্যকর প্রতিকার নিশ্চিত করা।
→ পুলিশ কেবল হত্যার পর মামলা নিয়েছে, প্রতিরোধ করেনি।
অতএব, রাষ্ট্র কেবল তার নাগরিকদের নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারকেও ব্যর্থ করেছে।
আইনই শেষ ভরসা:
প্রতিটি ঘটনায় দেখা যায়, ভয় ও গুজব যখন আইনের স্থান দখল করে, তখন সমাজ নিজের নৈতিকতা হারায়।
এই হত্যাকাণ্ডগুলো কেবল কয়েকটি খবর নয়—এগুলো আমাদের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতার রক্তাক্ত সাক্ষ্য।
সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নাগরিক সমাজের এখনই উচিত—
প্রতিটি মব জাস্টিস ঘটনার দ্রুত, নিরপেক্ষ তদন্ত,
অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি,
জনতার হাতে বিচার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক সচেতনতা গড়ে তোলা,
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে মানবাধিকার শিক্ষা ও তথ্যনির্ভর সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
আমাদের মনে রাখতে হবে —
-ন্যায়বিচার আদালতের হাতে, জনতার হাতে নয়।
- প্রকৃত নিরাপত্তা আসে আইনের শাসন থেকে, প্রতিশোধ থেকে নয়।
বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিকে সত্যিকার অর্থে রক্ষা করতে হলে
এই বার্তাই হতে হবে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বজনীন অঙ্গীকার।
লেখক:
জয়দেপ চৌধুরী
এলএলবি (অর্নস), এলএলএম (ফার্স্ট ক্লাস)
লেকচারার, আইন বিভাগ, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা