ইউরিয়া সার উৎপাদনের মূল কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার প্রস্তাব নিয়ে আজ, সোমবার (০৬ অক্টোবর ২০২৫), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গণশুনানি করেছে। গ্যাস-সংকটের কারণে বছরের বেশিরভাগ সময় সরকারি সার কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন কমছে এবং চাহিদা মেটাতে চড়া দামে সার আমদানি করতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে।
জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি'র এই গণশুনানিটি রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সার কারখানার জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার অভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেছে। তবে বিইআরসি গঠিত কারিগরি কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ৩০ টাকা নির্ধারণের যৌক্তিকতা দেখানো হয়েছে।
পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবনায় বলা হয়, বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে গড়ে খরচ হচ্ছে ২৮ টাকা ৭৮ পয়সা, কিন্তু বিক্রি করা হচ্ছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সা। এতে প্রতি ঘনমিটারে লোকসান হচ্ছে ৫ টাকা ৮৫ পয়সা। এই লোকসানের ফলে চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার ২৯১ কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে, যেখানে সরকার ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে এই ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে বলে তারা উল্লেখ করে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে ৫টি সরকারি ইউরিয়া সার কারখানা পরিচালিত হয়। বিসিআইসির কর্মকর্তারা শুনানিতে জানান, গ্যাসের অভাবে গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) যমুনা সার কারখানা ৩৫১ দিন, আশুগঞ্জ ২৫৯ দিন, শাহজালাল ১৪৭ দিন এবং চট্টগ্রাম ইউরিয়া কারখানা ৮১ দিন বন্ধ ছিল।
বিসিআইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে যেখানে সার উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ১৭ হাজার টন, তা কমতে কমতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ লাখ ১০ হাজার টনে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭ লাখ ১৮ হাজার টনে নেমে আসে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৬ লাখ ৯৪ হাজার টন। যদিও গত অর্থবছরে ঘোড়াশালের নতুন সার কারখানার প্রায় ৮ লাখ টন উৎপাদনসহ মোট উৎপাদন ১০ লাখ টন ছাড়িয়েছে।
বিসিআইসির পরিচালক (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) দেলোয়ার হোসেন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে বলেন, দাম বাড়াতেই হলে ১৬ টাকা থেকে ৪ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা করা যেতে পারে। তবে তিনি এ-ও উল্লেখ করেন যে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা করা হলেও সার আমদানির চেয়ে দেশে উৎপাদন খরচ কম হবে।
শুনানিতে অংশ নেওয়া অংশীজনেরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতিতে পূর্বে দাম বাড়ানোর পরেও গ্যাস না পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। তারা বলেন, ২০২২ সালে গ্যাসের দাম শিল্পে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হলেও বাড়তি দাম দিয়েও গ্যাস পায়নি শিল্প। সার কারখানায় তখন ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে ১৬ টাকা করা হলেও কারখানা বন্ধ ছিল।
নাগরিকদের একাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে বলেন, এতে সারের উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা পরবর্তীতে সারের দাম বাড়িয়ে কৃষিপণ্যের খরচ এবং চূড়ান্তভাবে ভোক্তার ওপর প্রভাব ফেলবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামান বলেন, কৃষক পর্যায়ে সারের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। তবে বাড়তি উৎপাদন খরচের দায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে মেটালে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে।
শুনানি শেষে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ায় কৃষি। তাই কৃষির জন্য বোঝা তৈরি করা যাবে না। তিনি সার কারখানায় উৎপাদন ধরে রাখা এবং পেট্রোবাংলার ঘাটতি না হওয়ার বিষয় দু'টিকেই গুরুত্ব দিয়ে সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান। তিনি ১৩ অক্টোবরের মধ্যে লিখিত মতামত জানানোর সুযোগও দেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) অবশ্য শুনানিতে অংশ নেয়নি। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সারের দাম বাড়বে, কৃষি ধ্বংস হবে এবং দেশ আমদানি বাজারে পরিণত হবে।