প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণ প্রক্রিয়া বন্ধে অবিলম্বে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেসব বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তার সমাধান ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা সম্ভব। পূর্ণাঙ্গ জাতীয় রাজনৈতিক মীমাংসার অপেক্ষা না করেই এ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান।
ড. ইউনূস মিয়ানমারে চলমান সংঘাত নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই সংঘাত কেবল আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না, বরং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে। আট বছর পরেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান দৃশ্যমান নয়। উপরন্তু, বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে, সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির কারণেই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর অধিকার বঞ্চনা ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, রাখাইন সমস্যার চূড়ান্ত রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য। এর জন্য রাখাইন অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট সব জাতিসত্তার অংশগ্রহণে এমন একটি বন্দোবস্ত প্রয়োজন, যেখানে রোহিঙ্গারা সম-অধিকার ও নাগরিকত্বসহ সমাজের অংশ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো রোহিঙ্গারা এবং তারপরেই বৃহত্তম ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। তবে রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। বাংলাদেশ শুধু একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে।
ড. ইউনূস রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ভয়াবহ তহবিল সংকটের বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, এই কারণে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখার যৌথ প্রয়াস ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে মারাত্মক তহবিল ঘাটতি দেখা দেওয়ায়, নতুন তহবিল না এলে মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে মাথাপিছু মাত্র $৬ মার্কিন ডলারে নামতে পারে। তিনি সতর্ক করেন যে, এটি রোহিঙ্গাদের অনাহার ও অপুষ্টিতে নিমজ্জিত করবে, যা সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করে ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়াতে তিনি বিদ্যমান ও সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান বৃদ্ধির আহ্বান জানান।
মানবিক সহায়তার জন্য নতুন ও বর্ধিত তহবিলের বাইরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকার বা রাখাইনের অন্যান্য অংশীদারদের ওপর ইতিবাচক পরিবর্তন এবং দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে বলে ড. ইউনূস মন্তব্য করেন। তিনি অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোকেও তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যেকোনো যৌথ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা দিতে বাংলাদেশ সদাপ্রস্তুত বলেও তিনি জানান।
ড. ইউনূস আশা প্রকাশ করেন, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন বিশ্বব্যাপী দৃঢ় সংকল্প তৈরি করবে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য বাস্তবসম্মত আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করবে, যেখানে তহবিল সংগ্রহ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। একইসঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক রোডম্যাপ ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।