কিছুদিন আগে ডাকসু নির্বাচন ও ১৯৮২ সালের বোমা হামলায় আহত হওয়ার স্মৃতি নিয়ে আমার লেখা অনেকে শেয়ার করেছেন। আজ শেয়ার করতে চাই জীবনের আরেকটি অধ্যায়—যা আমার জন্য এক অবিস্মরণীয় বেদনাবিধুর অভিজ্ঞতা। তবে সেই ট্র্যাজেডির মাঝেও আল্লাহর এক বিশেষ পরিকল্পনা ছিল, যা আমি পরে উপলব্ধি করতে পেরেছি।
শুরুটা ছিল জাহাঙ্গীরনগরে
১৯৮৮ সালের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। অল্প সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবাই জেনে যায় আমি অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে। একমাত্র দাড়িওয়ালা ছাত্র হিসেবে আমার পরিচিতি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর পর শুরু হয় এক অদৃশ্য চাপ ও বিড়ম্বনা।
প্রায়শই কানে আসত কটূক্তি—“গোলাম আযম আব্বাস খান, চলে যাও পাকিস্তান।” কেউ কেউ আবার কাছে ডেকে নিশ্চিত হতে চাইত আমি সত্যিই গোলাম আযমের ছেলে কি না। যদিও সরাসরি আঘাত বা শারীরিক অপমানের শিকার হইনি, কিন্তু দূর থেকে টিটকারি ও দৃষ্টির আঘাত সহ্য করতে হত নিয়মিত। আমার সহপাঠীরা মাঝেমধ্যেই ঠাট্টা করে বলত—“তুই এক কাজ কর, গলায় একটা বোর্ড ঝুলিয়ে দে, লিখে রাখ ‘হ্যাঁ, আমি গোলাম আযমের ছেলে। প্লিজ, আর তাকাবেন না।’”
রাজনীতি নয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সম্পৃক্ততা
ক্যাম্পাসে শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি করলেও আমি কখনও সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমার সম্পৃক্ততা ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে। ভর্তি হওয়ার সময় আমি সংগঠনের সহকারী পরিচালক, আর ১৯৮৯ সালের মার্চ/এপ্রিলে পরিচালকের দায়িত্ব নেই। তবুও সেই কটূদৃষ্টি থেকে রেহাই পাইনি।
একদিন নিরাপত্তাহীনতার কথা আব্বাকে বললে তিনি আমাকে দুটি দোয়া পড়ার পরামর্শ দেন:
হাসবুনাল্লাহি নি’মাল ওয়াকিল, নি’মাল মাওলা ওয়া নি’মান নাসির
রাব্বি আউযুবিকা মিন হামাদাতিশ শায়াতিন
১৯৮৯ সালের অস্থির আগস্ট
১৯৮৯ সালের আগস্টের মাঝামাঝি, আমাদের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার দুই সপ্তাহ আগে, পরিস্থিতি হঠাৎ ঘোলাটে হয়ে যায়। শান্তিনগর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ওঠার সময় শুনলাম আগের রাতে শিবির ও ছাত্রদলের সংঘর্ষ হয়েছে। আমার এক সহপাঠী, যে প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমার সঙ্গে ছিল, সতর্ক করে বলল ক্যাম্পাসে না যেতে। আমি প্রথমে গুরুত্ব দিইনি, কিন্তু সে জোর করে আমাকে মগবাজারে নামিয়ে দেয়। পরে বিকেলে খবর পাই, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা প্রতিটি বাসে আমাকে খোঁজা হয়েছিল।
এর পর আর কখনও ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি। পরবর্তীতে তথাকথিত প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো একযোগে শিবিরকে নিষিদ্ধ করে এবং ১৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে, যাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা থাকবে। যদিও আমার নাম তালিকায় ছিল না, তবুও প্রবেশের কোনো সুযোগ আর অবশিষ্ট ছিল না। কেউ জানালো, যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিই যে শিবিরের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। কিন্তু সেই শর্ত মানা আমার কাছে আত্মসমর্পণের শামিল ছিল, তাই ফিরিনি।
অপূর্ণতা থেকে নতুন পথ
এইভাবে জীবনের দুই বছর হারিয়ে যায়। আশায় আশায় অপেক্ষা করেছি, হয়তো আবার পড়াশোনায় ফিরতে পারব। কিন্তু তা হয়নি। হতাশ হয়ে পড়ি। এরপর বিদেশে চেষ্টা শুরু করি। ইংল্যান্ডে ভিসার জন্য আবেদন করলেও ব্যর্থ হই। পরে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই।
অনেকে পাকিস্তানে যেতে পরামর্শ দিলেও, পাকিস্তানিদের উদ্দেশে শুনতে হওয়া কটূক্তি মনে করে আলীগড়কে বেছে নিই। আরেকটি কারণ ছিল, আমার এক বন্ধু তখন আলীগড়ে পড়ছিল এবং সেখানকার পরিবেশ আমার কাছে ভীষণ ভালো লেগেছিল। সেখানেই Linguistics বিভাগে ভর্তি হই। বিস্ময়করভাবে এই বিষয়টি আমার জীবনের আসল আগ্রহে পরিণত হয়। বুঝলাম—আল্লাহ যা করেন, মানুষের কল্যাণের জন্যই করেন।
৩৬ বছর পরের বাস্তবতা
আজ ৩৬ বছর পর যখন দেখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ২৫টির মধ্যে ২০টি পদ ছাত্রশিবিরের প্যানেলের দখলে, তখন মনে হয় ইতিহাস নিজেই উত্তর দিয়েছে। যে ক্যাম্পাস একসময় বামপন্থীদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, সেখানেই ফলাফল ঘোষণার সময় ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়েছে।
এ এক ধরনের poetic justice। জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ আজকের ছাত্র রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সামনেই রাকসু ও চকসু নির্বাচন—আশা করি এই অগ্রযাত্রা ইনশা আল্লাহ থামবে না।
বিজয়ীদের প্রতি বার্তা
আজকের বিজয়ীদের প্রতি আমার অভিনন্দন। তবে মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। তোমাদের উপর যে আমানত ন্যস্ত হয়েছে, তা রক্ষা করা এখন ঈমানি দায়িত্ব। তোমরা শুধু ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধি নও, বরং প্রায় বারো হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি।
আল্লাহ তোমাদের দায়িত্ব পালনের তৌফিক দান করুন—এই দোয়া করি।
সংগৃহীত: ফেসবুক আইডি/সালমান আল আযমী