সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ইলিশের দাম আনা এবং মাছ আহরণকারী জেলেদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমাতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিএটিসি) মোট ১৩টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ করেছে। পুঁজি স্বল্পতার কারণে জেলেরা উচ্চ সুদের বিনিময়ে দাদন প্রদানকারীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এই সমস্যা সমাধানে, কমিশন সহজ শর্তে জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করে জেলেদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছে।
বিটিএটিসি বাজারে ইলিশের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে একটি সমীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা করছে বলে ক্রেতাদের অভিযোগ রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, ট্যারিফ কমিশন ইলিশের আকার অনুযায়ী সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে, যা ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সরকারি সংস্থাটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রপ্তানির পরিমাণ খুব বেশি না হওয়া সত্ত্বেও, রপ্তানি মূল্য স্থানীয় বাজারমূল্যের প্রায় অর্ধেক। এই তথ্য নির্দেশ করে যে, বিদ্যমান রপ্তানি মূল্যে যদি ব্যবসায়ীরা মুনাফা করতে পারে, তবে স্থানীয় বাজারে উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় অস্বাভাবিক হারে মুনাফা করা হচ্ছে। সরকার গত ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে পার্শ্ববর্তী দেশে (কলকাতা) ১২০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়। সেই অনুমতির ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ১৫৩৩.৯০ টাকা ধরা হয়েছিল, যেখানে স্থানীয় বাজারে তার চেয়েও বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুসারে, গত চার মাসে ইলিশের দামে ঊর্ধ্বগতি স্পষ্ট। জুনে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ৬০০ থেকে ২২০০ টাকা ছিল। জুলাইয়ে তা বেড়ে ৯০০ থেকে ২০০০ টাকায় দাঁড়ায়। আগস্টে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম কিছুটা কমে ৮০০ থেকে ২০০০ টাকা হয়। তবে সেপ্টেম্বরে তা পুনরায় বেড়ে ৯০০ থেকে ২২০০ টাকায় পৌঁছায়।
গত পাঁচ বছরে দেশে ইলিশের দাম ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর পেছনে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, মজুদ ও সিন্ডিকেট, জ্বালানি তেল ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, মাছ ধরার খরচ বৃদ্ধি, নদীর নাব্যতা সঙ্কট, পরিবেশগত কারণ, অবৈধ জালের ব্যবহার, দাদন, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং রপ্তানিকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইলিশের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ এবং বাজার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ট্যারিফ কমিশন সরকারের কাছে নিম্নলিখিত ১৩টি সুপারিশ পেশ করেছে:
১. সমবায় সমিতি গঠন: মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব কমাতে জেলেদের সমবায় সমিতি গঠনে উৎসাহিত করা, যাতে তারা সরাসরি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে পাইকার বা বড় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে মাছ বিক্রি করতে পারে। ২. অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও সরবরাহ শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) ছোট করতে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে জেলেরা বা তাদের সমিতি মাছের তথ্য (পরিমাণ, আকার, প্রস্তাবিত মূল্য) আপলোড করতে পারবে। ৩. বিশেষ বিপণন কেন্দ্র: ইলিশ উৎপাদন মৌসুমে প্রধান শহরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করা, যেখানে জেলেরা বা তাদের সমিতি ন্যায্যমূল্যে সরাসরি মাছ বিক্রি করতে পারবে। ৪. আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা: মাছের অপচয় রোধ ও গুণগত মান বজায় রাখতে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও প্রধান পরিবহন রুটগুলোতে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ, আইস প্ল্যান্ট এবং রেফ্রিজারেটেড ভ্যান/ট্রাক নিশ্চিত করা। ৫. বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন: সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য মৎস্য সাপ্লাই চেইনে জড়িত সব আড়তদার ও পাইকারদের বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স দিয়ে কর নেটের আওতায় আনা। ৬. নিয়মিত বাজার তদারকি: কৃত্রিম সঙ্কট ও অতিরিক্ত মুনাফা রোধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করা। ৭. বাজার তথ্যের সরবরাহ: জেলেদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে মোবাইলে এসএমএস বা অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিদিনের বাজারদর, চাহিদা এবং সরবরাহের তথ্য পৌঁছে দেওয়া। ৮. ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম: লেনদেনে স্বচ্ছতা আনা এবং দাদন প্রদানকারীদের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে জেলেদের জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের প্রচলন নিশ্চিত করা। ৯. আইন প্রয়োগ ও সংশোধন: উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, মূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ইলিশ সংরক্ষণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং প্রয়োজনে সংশোধন করা। ১০. জাতীয় নীতি প্রণয়ন: ইলিশের ন্যায্যমূল্য এবং সুষম বণ্টনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট জাতীয় নীতি প্রণয়ন করে সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি ধাপে যৌক্তিক মুনাফা নির্ধারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১১. জেলেদের প্রশিক্ষণ: মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি কমাতে জেলেদের মাছ ধরা পরবর্তী পরিচর্যা, সংরক্ষণ এবং প্রাথমিক বিপণন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া। ১২. আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি: দাদন প্রদানকারীদের প্রভাব কমাতে সহজ শর্তে জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণ এবং ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করে জেলেদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ১৩. সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ: দাদন ব্যবসায়ীদের উচ্চ ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণকে নিরুৎসাহিত করতে সরকার কর্তৃক ইলিশের সাইজ অনুযায়ী সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া।
কমিশন মনে করে, এই পদক্ষেপগুলো সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ইলিশের সরবরাহ শৃঙ্খল আরও দক্ষ ও স্বচ্ছ হবে, যা জেলে ও ভোক্তাদের জন্য সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের অবদান প্রায় ৪২ শতাংশ, যার মধ্যে ইলিশ এককভাবে মোট সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ। এটি মৎস্য খাতের মোট আয়ের প্রায় ১.২ শতাংশ অবদান রাখে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা সত্ত্বেও, পরিবেশগত পরিবর্তন, জলাশয় সংকোচন, দূষণ, নির্বিচারে জাটকা নিধন, মা ইলিশ আহরণ এবং কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহারের ফলে ইলিশ সম্পদ হুমকির মুখে। এই প্রেক্ষাপটে জনস্বার্থে মূল্যবৃদ্ধির কারণগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য বলে কমিশন মনে করে।