বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া বাবা-মায়ের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতা সাময়িকভাবে শিথিল করেছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচির কারণে এই অস্থায়ী ছাড় দেওয়া হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন অফিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সফটওয়্যার ‘বিডিআরআইএস’-এ বয়সসীমা নির্ধারণ করার ফলে গত এপ্রিল মাস থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী মায়ের ও ২১ বছরের কম বয়সী বাবার সন্তানের জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া আটকে যাচ্ছিল।
রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভার এক ২৬ বছর বয়সী বাবা এপ্রিল মাসে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের আবেদন করেও একই সমস্যার সম্মুখীন হন, কারণ তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১৮ বছরের কম। পরে স্ত্রীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর নিবন্ধন সম্পন্ন হয়।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচে ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য। আইনটি মেনে সফটওয়্যারে বয়স নির্ধারণের ফলে এপ্রিল মাস থেকে এই বয়সী বাবা-মায়ের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে বিশেষ করে মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার বেশি হওয়ায় মায়ের বয়সজনিত সমস্যাটি প্রকট হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি হাজারে ৭৩ জন মেয়ে এবং ১৪ জন ছেলে বিয়ে করছে (বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩)। ইউএনএফপিএর ‘বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১ হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন এক বা একাধিক সন্তানের মা। এই বিপুল সংখ্যক শিশুর জন্মনিবন্ধন আটকে যাওয়ায় টাইফয়েড টিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হলে বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে।
এক ডোজ টিকা দিয়ে টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধের লক্ষ্যে সরকার আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। এতে প্রায় ৫ কোটি শিশু টিকা পাবে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) মো. যাহিদ হোসেন গত রোববার প্রথম আলোকে জানান, জন্মনিবন্ধন না হলে শিশুদের টাইফয়েড টিকার জন্য নিবন্ধন করা যাবে না। এই কারণে সাময়িকভাবে সিস্টেমে মায়ের বয়স ১৬ বছর করে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে ১৬ বছর বা এর বেশি বয়সী মায়ের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশজুড়ে ৭৭ লাখ ৮১ হাজার ৩৯০টি জন্মনিবন্ধন এবং ৬ লাখ ৮৯ হাজার ১৫টি মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্য নিয়ে আজ ৬ অক্টোবর জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস পালিত হচ্ছে।
তবে জন্মনিবন্ধন আইন ও বিধিমালা অনুসারে, সবার জন্মনিবন্ধন হওয়া বাধ্যতামূলক এবং এটি নাগরিকের অধিকার। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম এই প্রসঙ্গে বলেন, "বাল্যবিবাহের প্রসঙ্গ তুলে কোনো মা–বাবার সন্তানের জন্মনিবন্ধন না করলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।"
খাগড়াছড়ি পাবর্ত্য জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার গত ১৮ আগস্ট রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর চিঠিতে বয়সজনিত জটিলতার বিষয়ে দিকনির্দেশনা চেয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২৪ আগস্ট এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর সন্তানের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবা–মায়ের বয়স-সংক্রান্ত বাধা সরাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নির্দেশের পরেই রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় সিস্টেমে বয়সের ক্ষেত্রে আপাতত পরিবর্তন আনে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন জানান, অক্টোবরের পর বয়সের বাধা স্থায়ীভাবে তুলে নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি ভবিষ্যতে জটিলতা এড়াতে সব বিয়ের অনলাইন নিবন্ধন এবং কাজিদের মাধ্যমে হওয়া বিয়েগুলো ইলেকট্রনিক ফরমেটে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।